জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শিবিরের ‘ভোট ইঞ্জিনিয়ারিং’ ও নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট শেষ হওয়ার দেড় ঘণ্টা আগে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল। তাদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে। এটা আমরা কোন রকম ভাবে মেনে নিতে পারি না। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জনের ঘোষণা দেয় ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল। তাদের অভিযোগ—ব্যাপক অনিয়ম, ভোট কারচুপি ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের কারণে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী তানজিলা হোসেন বৈশাখী বলেন, “শুরু থেকেই আমাদের আশঙ্কা ছিল এটি সাজানো নির্বাচন হবে। আমরা বারবার প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম যে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, কিন্তু প্রশাসন আমাদের দাবি উপেক্ষা করেছে। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন হলে ভোটগ্রহণে অনিয়ম, জাল ভোট, নকল ব্যালট ব্যবহার, পোলিং এজেন্টদের কাজে বাধা দেওয়া এবং শিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রদলের সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী মো. শেখ সাদী হাসান অভিযোগ করেন, জামায়াতে ইসলামীর মালিকানাধীন একটি কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন সংগ্রহ করেছে প্রশাসন। ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যালট পেপারেই ভোট নেওয়া হচ্ছে, যা কারচুপির বড় আশঙ্কা তৈরি করেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ও শিবিরপন্থী শিক্ষার্থীরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, ভোট সুষ্ঠুভাবেই চলছে এবং শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে অংশ নিচ্ছে। বরং ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল নিশ্চিত পরাজয় আঁচ করেই নাটক সাজিয়েছে। এ বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, তারা নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে বর্জনের ঘোষণার কারণে পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে বলে স্বীকার করেছেন একাধিক কর্মকর্তা। এদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে বলেন, বর্জনের কারণে তাদের ভোটাধিকার অর্থহীন হয়ে গেল। একজন শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা ভোট দিতে চাই। কিন্তু যদি আগে থেকেই ঠিক করা থাকে কে জিতবে, তাহলে এই নির্বাচন কেন? অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচনকে ঘিরে এই উত্তেজনা।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবান্ধব পরিবেশকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত ও বিতর্কিত। নব্বইয়ের দশক থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের শক্তিশালী অবস্থান বিদ্যমান। এর আগে ২০০৮ সালের জাকসু নির্বাচনও কারচুপির অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। পরে দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বারবার আন্দোলন করেছে। এবারের নির্বাচনকে তাই অনেকে গণতান্ত্রিক চর্চার নতুন সূচনা হিসেবে দেখছিলেন। কিন্তু বর্জনের ঘটনায় সেই আশায় ধাক্কা লেগেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই বর্জন শুধু একটি সংগঠনের অবস্থান নয়; বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন। অনিয়মের অভিযোগ নতুন কিছু নয়, কিন্তু প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন ওঠা উদ্বেগজনক। অনেকেই মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক চর্চা আরও দুর্বল হবে। জাকসু নির্বাচন নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক এখন সারাদেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, নির্বাচন যদি প্রকৃত অর্থে সুষ্ঠু না হয়, তবে এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের বর্জন তাই শুধু ক্যাম্পাস নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও নতুন বার্তা বহন করছে।